মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে ধন্যবাদ জানাই যে তিনি অবশেষে বুঝতে পেরেছেন, ব্যাংকে জমা টাকার ওপর গ্রাহকদের কাছ থেকে আবগারি কর নেওয়া সমীচীন হয়নি। সংসদ বাংলা অভিধান অনুযায়ী ‘আবকারি’ বা ‘আবগারি’ শব্দের অর্থ লেখা আছে, ‘মাদকদ্রব্যের ব্যবসায়, মাদকদ্রব্যসংক্রান্ত রাজস্ব।’ মাদকের সঙ্গে তামাকও না হয় যোগ করা যায়। আমরা এত দিন মাদক ও তামাকের ওপরই আবগারি কর বসানোর কথা জেনে এসেছি। এখন দেখছি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কেরামতিতে ব্যাংকে সঞ্চিত অর্থের ওপরও আবগারি কর বসল।
সাংবাদিক কামাল আহমেদ বাজেট প্রস্তাবের পরপরই প্রথম আলোতে লিখেছিলেন, ‘...এবারের বাজেটে “পাপ কর”-এর হারটা বাড়িয়ে দিয়ে তিনি (অর্থমন্ত্রী) আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে আমরা যেহেতু “পাপ করে”ই চলেছি, সেহেতু আমাদের “পাপ কর”-এর হার বাড়বে।’
গতকাল রোববার অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে সোনালী, অগ্রণী, জনতাসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ১৬টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) সই অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘আবগারি শুল্ক নামটা কোনোমতেই হওয়া উচিত নয়। এটা আয়করেরই অংশ। একে কীভাবে বর্ণনা করা যায়, সেটা পরে চিন্তা করা যাবে।’
জাতীয় সংসদে বাজেট প্রস্তাব পেশের পর যখন চারদিক থেকে ব্যাংকে জমা অর্থের ওপর আবগারি কর নিয়ে সমালোচনা হতে থাকল, তখনো অর্থমন্ত্রী বিষয়টি আমলে নিতে চাইলেন না। সিলেটে এক সমাবেশে তিনি জানিয়ে দিলেন, ‘আবগারি কর কমানো হবে না।’ পরে জাতীয় সংসদে সরকারদলীয় সাংসদেরা এ নিয়ে কঠোর সমালোচনা করলেন। একজন সাংসদ অর্থমন্ত্রীকে জেদ বজায় না রেখে আবগারি কর প্রত্যাহারের দাবি জানালেন। কেবল সাংসদ নন, খোদ মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য আবগারি কর কমানোর কথা বলেছেন। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় ব্যাংক হিসাবে বাড়তি আবগারি কর আরোপের প্রস্তাবকে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি যথার্থই প্রশ্ন রেখেছেন, ‘বাড়তি আবগারি শুল্ক থেকে সরকার কত পাবে? আয় আসবে ২০০ কোটি টাকার মতো। এ জন্য বিপুল লোকের আয় কমিয়ে দেব? অর্থমন্ত্রী কি আমাদের যক্ষের ধনের পাহারাদার বানাচ্ছেন? পুরো প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিলে ক্ষতি হবে বড়জোর ৩৫৫ কোটি টাকা। এটা বাজেটের খুবই ক্ষুদ্র অংশ।’
সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানোর বিরোধিতা করে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ১০ শতাংশ সুদ ধরলেও হবে এক হাজার কোটি টাকা। এর সুবিধা পাবে লাখ লাখ লোক। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর প্রস্তাব বাজেটে নেই। তবে অর্থমন্ত্রী দুই মাসের মধ্যে কমাবেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। তাঁর মতে, ‘আমরা অনেক শ্রেণির মানুষকে ভর্তুকি দিই, যাঁরা প্রাপ্য নন। তার চেয়ে বড় কথা, ঋণখেলাপিদের বিশাল বোঝা নিয়ে তোয়াজ করতে পারি, তাহলে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের সামান্য বোঝা নেব না কেন?’ জনগণের মনের কথাই বলেছেন কৃষিমন্ত্রী।
গতকাল অর্থমন্ত্রী ব্যাংক সঞ্চয়ের ওপর আবগারি কর কমানোর আভাস দিলেও নিজের অবস্থান থেকে বিন্দুমাত্র সরে এসেছেন, তা বলা যাবে না। সমালোচনাকারীদের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘আমার ধারণা, যখন কোনো কিছু খুঁজে না পাওয়া যায়, তখন কিছু একটা তো বের করতে হয়। এবার এটা (আবগারি শুল্ক) খুব বেশিভাবে হয়েছে।’ তাঁর যুক্তি, যাঁদেরই ব্যাংক হিসাব আছে, বহু বছর ধরেই তাঁরা এটা (আবগারি শুল্ক) দিয়ে যাচ্ছে। এটা নতুন কিছু নয়। এ বছর হারটা একটু বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। সুযোগও কিন্তু বাড়ানো হয়েছে। ২০ হাজার টাকা থাকলেই শুল্ক দিতে হতো, এখন এক লাখ টাকা পর্যন্ত কিছুই দিতে হবে না। ...এ নিয়ে এত চিৎকার যখন বাজারে আছে, তাই একটু পরিবর্তন হবে।’ এই যে আগে থেকে সরকার ব্যাংকে সঞ্চিত অর্থের ওপর কর নিত, সেটাই ছিল বেআইনি। সরকার সুদ বা লাভের ওপর কর দিতে পারে, মূলধনের ওপর নয়।
এবারের বাজেটে অর্থমন্ত্রী ব্যাংক হিসাবে ১ থেকে ১০ লাখ টাকা জমা হলে ৮০০ টাকা আবগারি কর কাটার প্রস্তাব করেছেন। আর ১০ লাখ টাকার ওপর থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত জমা থাকলে আড়াই হাজার টাকা দিতে হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সপ্তাহ দুই আগে ‘ব্যাংকে জমা রাখলে টাকা কমে যাবে’ শিরোনামে প্রথম আলোর অনলাইনে যে লেখাটি লিখেছিলাম, অর্থমন্ত্রীকে তার প্রতিক্রিয়াগুলো পড়ে দেখার অনুরোধ জানাই। একজন পাঠক লিখেছেন, ‘সকল খেলাপি ঋণ উদ্ধারে দ্রুত ব্যবস্থা নিন। প্রয়োজনে সম্পত্তি ক্রোকের আইন/ধারা যুগোপযোগী করুন। সাধারণ জনগণের কাছ থেকে আদায়কৃত অতিরিক্ত আবগারি বা ট্যাক্স দিয়ে খেলাপি ঋণের দায় শোধ করা উচিত হবে না।’ আরেকজন পাঠক লিখেছেন, ‘অর্থমন্ত্রী মহোদয় যেহেতু অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের হোতাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছেন না, তাই দায়টা চাপিয়েছেন নিরীহ মধ্যবিত্তের ওপরই।’
কৃষিমন্ত্রীও একই কথা বলেছেন, তাই মাননীয় অর্থমন্ত্রীর কাছে বিনীত অনুরোধ জানাব, ব্যাংকে সঞ্চিত টাকার ওপর আবগারি কর পুরোপুরি প্রত্যাহার করুন। এই আবগারি কর থেকে যা আয় হবে, তা চার লাখ কোটি টাকার বাজেটে কিছুই না।
অতএব, নিরীহ মধ্যবিত্তকে না মেরে, যারা ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা লোপাট করছে, তাদের ধরুন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন